আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিজেপি নেতারা ঘটনাটির বিরুদ্ধে কঠোর বিবৃতি দিয়েছেন এবং পশ্চিমবঙ্গে কর্মী-সমর্থকদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে এসব ঘটনায় প্রশান্ত মনোভাব প্রকাশ করা হচ্ছে, যা জাতীয় স্তরের হিন্দি ও ইংরেজি মিডিয়ার তুলনায় ভিন্ন।
অন্যদিকে কেন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করছেন না, তা নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে বিজেপির একাংশের নেতাকর্মীদের মধ্যে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানালেও, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়ে বলেছে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-ই প্রথমে মুখ খুলেছিলেন। ‘হিন্দুদের ওপরে হামলা’র মতো বিষয়ে তাকে আগেও কড়া প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা গেছে।
সেখানে অধিকারী সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানাচ্ছি আমরা। সারা পৃথিবীর সব হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আজ কলকাতায় বিজেপি বিধায়করা বিক্ষোভ দেখালেন। তবে বাংলাদেশে যদি হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার অতি সত্বর বন্ধ না হয় তাহলে আমরা আরও জোরালো বিক্ষোভ শুরু করব।
মঙ্গলবার রাতে কলকাতার বেহালা অঞ্চলে কোনও দলীয় পতাকা ছাড়াই হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠনের নেতা কর্মীরা মশাল মিছিল করেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের প্রতিবাদে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপরে কথিত হামলার বিরুদ্ধে স্লোগানও দিতে শোনা গেছে ওই মিছিলে।
এরপরে বুধবার সকালে বিজেপির সংসদ সদস্য ও রাজ্যে দলটির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ইথিওপিয়াতে মার্কিন অবরোধ, গাজা স্ট্রিপে ইসরাইলের হামলা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় মিছিল হয় আর আজ এত বড় অত্যাচার হচ্ছে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে (কোথায় প্রতিবাদ)? তারা আমাদের ভাই, তারা মারা যাচ্ছেন সেখানে, একটা শব্দ কেউ উচ্চারণ করতে পারছেন না? কোনও প্রতিবাদ হচ্ছে?
বিজেপি নেতা ও ‘কমিটি এগেইনস্ট অ্যাট্রসিটিস অন মাইনরিটিস অব বাংলাদেশ’ বা ‘ক্যাম্ব’-এর আহ্বায়ক মোহিত রায় দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপরে কথিত অত্যাচার নিয়ে সরব।
তিনি বলছিলেন, একটা রাজনৈতিক দল যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, যেমন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ বা মিছিল করা, সেরকম কিছু কিন্তু দল হিসাবে ভারতীয় জনতা পার্টি এখনও পর্যন্ত দেখায়নি। মঙ্গলবার রাতে যে মিছিল হয়েছে কয়েকটি স্থানীয় হিন্দু সংগঠন আয়োজন করেছিল, সেখানে আমিও ছিলাম, অনেক বিজেপি কর্মী সমর্থকও ছিলেন, কিন্তু সেখানে কোনো দলীয় পতাকা ছিল না। এটা নিয়ে বিজেপি কর্মীদের মধ্যে একটা হতাশাও কাজ করছে।
রায় বলেন, ‘তারা অন্য দেশের মানুষ হতে পারেন। কিন্তু তারা তো হিন্দু এবং বাঙালি হিন্দু। আমরা তো এটাও দেখেছি যে উত্তরপ্রদেশের একটা মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৯২ সালে পুরো বাংলাদেশের হিন্দু মন্দিরগুলোতে আক্রমণ-ভাঙচুর হয়েছিল। তবে দুঃখের ব্যাপার এটাই যে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে কিছু ঘটলে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা কিছু করছে না! তাদের তো সক্রিয় হওয়া উচিত। যেটুকু প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, তা অত্যন্ত কম।’
বিজেপি বা অন্য কোনো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন মুখে বেশ আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া দেখালেও রাস্তায় নেমে বিশেষ কোনো প্রতিবাদ যে এখনো দেখা যাচ্ছে না, তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কেউ কেউ বলছেন যে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলার ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ হিন্দুত্ববাদীদের আসল লক্ষ্য নয়।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিশ্লেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাক্রম নিয়ে বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো যে কড়া প্রতিক্রিয়া বা বিবৃতি দেয়, তার আসলে লক্ষ্য হল পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে হিন্দু ভোট এক-জোট করা। আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে এই পদ্ধতি তারা দীর্ঘদিন ধরেই অনুসরণ করছে, সম্প্রতি একই নীতি তারা প্রয়োগ করছে ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশাতেও। এই গোটা অঞ্চলে নানাভাবে তারা বাংলাদেশটাকেই ইস্যু করে তুলেছে।
তার কথায়, ‘এই পুরো অঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করছে, আবার হিন্দুদের বলছে তোমরা যদি বাংলাদেশের মতো টালমাটাল পরিস্থিতিতে পড়তে না চাও তাহলে এলাকা থেকে মুসলমান হটাও।’
মঙ্গল ও বুধবার দুদিনই ভারতের সংবাদপত্রগুলিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার, চট্টগ্রামের আদালতে তাকে পেশ করার পরবর্তী সহিংসতার খবরাখবর গুরুত্ব পেয়েছে। এই সংক্রান্ত খবরাখবর দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনের প্রাইম টাইম বুলেটিনগুলিতেও।
ভারতের জাতীয় সংবাদপত্রগুলিতে বুধবার চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারি ও বাংলাদেশের সহিংসতা নিয়ে যেধরণের শিরোনাম হয়েছে, তার বেশিরভাগেই রয়েছে ভারত সরকার যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, সেটি। যেমন ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসের শিরোনাম হল ‘Monk arrest: india flags safety of Hindus, Dhaka says it is deeply hurt’ অর্থাৎ সন্ন্যাসী গ্রেফতার – হিন্দুদের সুরক্ষার বিষয়ে উল্লেখ ভারতের, ঢাকা জানাল তারা ব্যথিত।
হিন্দুস্তান টাইমসের শিরোনাম হয়েছে ‘Protect all minorities, India tells bangladesh after arrest of hindu priest’ অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের রক্ষা করুন, হিন্দু সন্ন্যাসীকে গ্রেফতারের পরে বাংলাদেশকে বলল ভারত।
এই দুটি কাগজ ভারতের বিবৃতিকে গুরুত্ব দিলেও অন্যতম বেশি বিক্রির ইংরেজি পত্রিকা টাইমস অফ ইণ্ডিয়ার শিরোনাম একটু আলাদা। তারা লিখেছে India bangladesh tensions mount as hindu priest jailed for ‘sedition’, অর্থাৎ ‘দেশদ্রোহে’র জন্য হিন্দু সন্ন্যাসীর জেলের পরে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে টানাপোড়েন বাড়ল
দুটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দি দৈনিক অমর উজালা এবং দৈনিক জাগরণ প্রায় একই শিরোনাম করেছে, যেখানে তারা ভারত সরকারের বিবৃতিটিকে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছে যে হিন্দুদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করুক বাংলাদেশ, বলল ভারত।
আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় এক কলমের খবরের শিরোনাম হল: ‘চিন্ময়কৃষ্ণকে নিয়ে কড়া বিবৃতি দিল্লির, পালটা ঢাকারও’। তবে তারা ভেতরের পাতায় তিন কলাম জুড়ে বড় ছবি দিয়ে বিস্তারিত খবর ছেপেছে। তার শিরোনাম ছিল : ‘চিন্ময়কৃষ্ণ জেলে, রণক্ষেত্র চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী’।
বাংলা কাগজগুলির মধ্যে বাংলাদেশের এ সংক্রান্ত খবর দিয়ে সবথেকে বড় করে প্রতিবেদন ছেপেছে প্রতিদিন কাগজ।তারা শীর্ষ খবরের শিরোনাম দিয়েছে এভাবে : ‘সন্ন্যাসী গ্রেফতারে উত্তাল বাংলাদেশ – পুলিশের লাঠি, খণ্ডযুদ্ধে মৃত এক’।
প্রথম পাতায় আরও একটি খবর রয়েছে প্রতিদিন কাগজে, যেটি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইস্কনের বিবৃতি সংক্রান্ত।কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি কাগজ ‘দ্য টেলিগ্রাফ’এর শিরোনাম করা হয়েছে ‘Hindu preacher arrest triggers bangla clashes’, অর্থাৎ হিন্দু সন্ন্যাসী গ্রেফতারে বাংলায় সংঘর্ষ’।
সংবাদ পোর্টাল দ্য ওয়ালের কার্যকরী সম্পাদক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক অমল সরকার বলেন, ‘ভারতীয় গণমাধ্যম যেভাবে গত দুদিনের ঘটনাক্রম দেখাচ্ছে, সেটাকে দুটো ভাগে ভাগ করতে হবে আমাদের – একটা জাতীয় স্তরে কী দেখানো হচ্ছে বা ছাপা হচ্ছে আর অন্যটা পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার কাগজ-টিভিতে কী দেখানো হচ্ছে। ‘
তিনি আরও বলেন, সর্বভারতীয় গণমাধ্যম – ইংরেজি এবং হিন্দি দুই ভাষাতেই বাংলাদেশের এই ঘটনা নিয়ে যা দেখানো হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে সংবাদমাধ্যম যেন একটা রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মতো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে – প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তুলে ধরছে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা প্রথম সারির গণমাধ্যম কিন্তু সবসময়েই এধরনের ঘটনায় – তা বাংলাদেশের হোক বা অন্য কোনও জায়গায় – খুব সতর্কতা এবং সংযতভাবে উপস্থাপন করে।
তার কথায়, সেই ধারাবাহিকতায় কিন্তু এবার একটু ব্যত্যয় ঘটেছে। জাতীয় টিভি চ্যানেলগুলির যেসব বাংলা শাখা চ্যানেল আছে, তাদের কভারেজও কিন্তু জাতীয় স্তরের গণমাধ্যমের মতোই হচ্ছে। সেটা বেশ আগ্রাসী প্রতিবেদন করছে, সাংবাদিকতা ছাপিয়ে প্রতিবাদের স্বর উঠে আসছে যেন।
আপনার মতামত লিখুন :