সিন্ডিকেট ইস্যুতে ইউটার্ন নিলেন : বাণিজ্যমন্ত্রী


আজকালের কণ্ঠ প্রকাশের সময় : অগাস্ট ৩১, ২০২৩, ৪:১৯ অপরাহ্ন /
সিন্ডিকেট ইস্যুতে ইউটার্ন নিলেন : বাণিজ্যমন্ত্রী

আজকালের কন্ঠ ডেস্ক : নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট আছে এমন কথা বলেননি বলে দাবি করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেছেন, বাজারে সিন্ডিকেট আছে, সিন্ডিকেট ভাঙব— এ ধরনের কোনো কথা তো আমি বলিনি। বলেছি যে, আমাদের যখন জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, আমরা চেষ্টা করি, কখনো কখনো আমাদের লোকবল কম থাকার কারণে এমন হয়।

বুধবার সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ইউএস-বাংলা বিজনেস কাউন্সিলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শেষ সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। মঙ্গলবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম বাজারে সিন্ডিকেট নিয়ে প্রশ্ন করে বলেন, অনেক পণ্যের ব্যাপারে সিন্ডিকেট করে বাংলাদেশে ব্যবসা করে মানুষের পকেট থেকে অনেক টাকা নেওয়া হচ্ছে। সিন্ডিকেটের কথা দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও বলেন। সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না-দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা এমনটি বলেন। প্রধানমন্ত্রী জানতে চান সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না কোনো মন্ত্রী বলেছেন। জবাবে তিনি বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরবো তো।

প্রধানমন্ত্রী তাকে ধরার প্রসঙ্গে নিজেকে ডিফেন্ড করবেন কিনা সাংবাদিকরা জানতে চাইলে টিপু মুনশি আজ বলেন, গতকাল সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী কি বলেছেন, কি মিন (বোঝাতে) করেছেন, সেটি তিনি ভালো জানেন। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, গতকালের মিটিংয়ের পর তো আমি উনার (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা ছিলাম। এ বিষয়ে উনার সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি।

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করে বলেন, প্রশ্নটা ছিল এ রকম যে, আপনি বলেছিলেন যখন ক্রাইসিস তৈরি হয়, তখন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আরও ক্রাইসিস তৈরি হয়। এ কথাটি আপনি বলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, যে কথাটা আমি বলেছিলাম যে, জেল-জুলুমের ব্যবস্থা নিলে তারা, আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চাই। হঠাৎ করে জেল দিলে ভোগান্তিটা বাড়বে। ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ার পর আমি বলেছিলাম, প্রয়োজন হলে ডিম আমদানি করব।

এ বিষয়ে তা হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনার কোনো হয়নি?— এমন প্রশ্নে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমি উনার সঙ্গেই ছিলাম। হয়তো সময়ের স্বল্পতার কারণে উনি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। আর অ্যাকচুয়ালি কী কথা উনি আমাকে বলবেন আমি সেটি জানি না। আপনার মুখ থেকে শুনলাম বা কাগজে দেখলাম। একটা প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে উনি এ কথাটা বলেছেন।

ভারতের বাজার আর আমাদের বাজারের তারতম্য অনেক– এমন প্রশ্নের জবাবে টিপু মুনশি বলেন, ভারতের সঙ্গে সব বিষয়ে তুলনা করা সম্ভব নয়। আজ ভারতে চিনির দাম কম, কারণ তাদের উৎপাদন যেটা হয় চাহিদা মেটানোর পরও রপ্তানি করে। আর আমাদের ৯৯.৯ শতাংশ বাইরে থেকে আনতে হয়। সব জিনিস একরকম হবে তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো কোনো কোনো জিনিস একরকম হয়। পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেল, তখন ভারতে রেশনিং চালু করেছিল। যখন কাঁচামরিচের দাম বাড়ল, তখন ৩৫০ রুপিতে বিক্রি হয়েছে। এই মুহূর্তে দেখেন পেঁয়াজের ওপর ট্যাক্স বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা তাদের অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে কাজ করে। আমরা বিকল্প সোর্স থেকে আনার চেষ্টা করি। সব কিছু একরকম নয়। তবে হেবিটটা একরকম পাশাপাশি দেশ বলে।

শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি অনেকটা এগিয়েছে, আমরা সে তুলনায় পিছিয়ে আছি– এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শ্রীলংকা আর আমাদের অবস্থাটা ভিন্ন। শ্রীলংকার বড় যে আয় সেটা হলো পর্যটন খাত। সেটা তারা রিভাইভ করেছে বলে তারা উন্নতি করছে। পাশাপাশি ছোট দেশ, সে জন্য তারা উতরে গেছে। আমাদের তো বিশাল বড় একটা দেশ। আমাদের চেষ্টা চলছে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন— আমাদের একটু কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। আমাদের প্রতিনিয়ত চেষ্টা চলছে।

ডিমের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমি সেদিনও বলেছি, ডিমের কি দাম হওয়া উচিত সেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঠিক করবে না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দাম নিদিষ্ট করে দিয়েছে, এ রকম দাম হওয়া উচিত। আমরা চেষ্টা করছি তারা যে দামটা নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটা যেন বাজারে থাকে।

সার্বিক মূল্যস্ফীতি নিয়ে তিনি বলেন, গ্লোবাল অবস্থাটা দেখেন, আপনারা যখন দেখেন ইংল্যান্ডের দোকানেও যখন ৩টার বেশি টমেটো কেনা যাবে না, সে বিষয়ে রেস্ট্রিকশন দিয়ে দেয়। জার্মানিও দোকানগুলোতে তেলের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়। আমাদের এখানেও নিশ্চয়ই প্রভাব পড়েছে। মুহূর্তের মধ্যে সমাধান হবে তেমন তো নয়, তবে আমাদের প্রতিনিয়ত চেষ্টা চলছে। গ্লোবাল এই দুরবস্থার মধ্যেও যেন আমরা ঠিক থাকতে পারি।

গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্বে যুগান্তর সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম প্রশ্ন করেন, সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক ধকল যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে লক্ষ্য করছি, নিত্যপণ্যের ব্যাপারে মৌসুমি ব্যবসা পরিচালিত হয়। মজুত আছে, সরবরাহ আছে, তার পরও হঠাৎ করে জিনিসের দাম বেড়ে যায়। পেঁয়াজ, ডাবের ক্ষেত্রে দেখলাম। রাতারাতি পেঁয়াজ কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে যাচ্ছে। কাঁচামরিচের কেজি ১ হাজার টাকা দেখলাম। অনেক পণ্যের ব্যাপারে সিন্ডিকেট করে বাংলাদেশে ব্যবসা করে মানুষের পকেট থেকে অনেক টাকা নেওয়া হচ্ছে।

সাইফুল আলম তার প্রশ্নে বলেন, সিন্ডিকেটের কথা দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও বলেন। তারা বলেন, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যায় না। সেখানে হাত দিতে গেলে বিপদ আছে। আমরা মনে করি, সরকার অত্যন্ত শক্তিশালী। সরকার দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে। এ নিত্যপণ্যের মৌসুমি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে কিনা তা প্রধানমন্তীর কাছে জানতে চান তিনি।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিপদ আছে কে বলেছে, আমি ঠিক জানি না। আমরা তো সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

তখন যুগান্তর সম্পাদক বলেন, দুজন মন্ত্রী বলেছেন— সিন্ডিকেট আছে, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না। বাণিজ্যমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন? বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরব তো। তিনি বলেন, খাদ্যপণ্য নিয়ে কয়েকটা হাউস ব্যবসা করে। যখনই তারা দাম বাড়ায় আমরা আমদানি করি, বিকল্প ব্যবস্থা করি। যাতে তারা বাধ্য হয় দাম কমাতে। আমরা তো সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই। কাজেই সিন্ডিকেট থাকলে তা ভাঙা যাবে না, এটা কোনো কথা না। কত শক্তিশালী সিন্ডিকেট আমি জানি না, আমি দেখব কী ব্যবস্থা করা যায়।

উল্লেখ্য, গত ১১ আগস্ট রাজধানীর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক ছায়া সংসদে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ডিমের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বলেন, ডিমের দাম আমরা ঠিক করতে পারি না। এটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখে না। আমাদের জানার দরকার-ডিমের সঠিক দামটা কত? সেটা জানতে মন্ত্রণালয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে মাঠে নামাতে পারে। তবে আমরা সিন্ডিকেট বন্ধ করে দিলাম, তারা (সিন্ডিকেট চক্র) বাজারে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিল। তখন ভোক্তারা পণ্য পেল না। এ জন্য আমাদের সব দিকে খেয়াল রাখতে হয়।

এর আগেও বাণিজ্যমন্ত্রী নিত্যপণ্য নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তারা পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দেবে। তখন ভোক্তা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে ২৬ জুন জাতীয় সংসদ অধিবেশনে তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বিশেষ করে বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে সংসদে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কোনো কোনো সংসদ সদস্য তো সরাসরি বলেই ফেলেন যে, বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রীর যোগসাজশ রয়েছে।

এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। এটা ঠিক বড় বড় গ্রুপগুলো একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তবে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার— আমরা জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম; সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে, সেটাও তো সইতে আমাদের কষ্ট হবে। এ জন্য আমরা আলোচনার মাধ্যমে নিয়মের মধ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।