আজকালের কন্ঠ ডেস্ক: পরিবেশদূষণের অন্যতম কারণ মানুষের দ্বারা প্রকৃতির অবক্ষয়। বিভিন্ন ধরনের পরিবেশদূষণের মধ্যে প্লাস্টিকদূষণ এ সময় আমাদের মনোযোগ দখল করে আছে। প্লাস্টিকের মতো কৃত্রিম উপকরণ আবিষ্কারের মাধ্যমে পরিবেশদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ১৯৬২ সালে প্লাস্টিক আবিষ্কৃত হলেও ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার শুরু হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমরা যে কম্পিউটারে কাজ করছি, যে মোবাইল ফোনসেট ব্যবহার করছি, কিংবা যে বালতিতে গোসল করছি, এর বেশির ভাগই প্লাস্টিকের তৈরি। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার যেসব যন্ত্র ব্যবহার করছেন, তারও বেশির ভাগ প্লাস্টিকের তৈরি। প্লাস্টিক আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। প্লাস্টিকের বিভিন্ন রকমভেদ থাকলেও একবার ব্যবহারের জন্য তৈরি প্লাস্টিকই বহুল জনপ্রিয়। একক ব্যবহারের প্লাস্টিক ব্যাগগুলো নর্দমা আটকে দেয় এবং মশা ও কীটপতঙ্গের জন্য প্রজননক্ষেত্র তৈরি করে। এর ফলস্বরূপ ম্যালেরিয়ার মতো ভেক্টরবাহিত রোগের সংক্রমণ বাড়ে। প্লাস্টিক খাল-বিল, নদীনালার প্রবাহ, সমুদ্রসৈকত এবং তলদেশ, এমনকি মাটির উর্বরতা বর্তমানে নষ্ট করছে, যার আছে মারাত্মক পরিবেশগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত পরিণতি।
ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রগ্রাম বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে এক মিলিয়ন প্লাস্টিকের বোতল কেনা হয় এবং প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী পাঁচ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। উৎপন্ন সব প্লাস্টিকের অর্ধেক একক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ডিজাইন করা হয়েছে, যা একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিকসহ প্লাস্টিক এখন আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে সর্বব্যাপী। এটি পৃথিবীর জীবাশ্ম রেকর্ডের অংশ হয়ে উঠছে এবং আমাদের বর্তমান ভূতাত্ত্বিক যুগের অ্যানথ্রোপোসিনের চিহ্নিতকারী হয়ে উঠছে। এমনকি এটি ‘প্লাস্টিস্ফিয়ার’ নামে একটি নতুন সামুদ্রিক জীবাণুর আবাসস্থলের নাম দিয়েছে।
শুরুতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কম থাকায় এর বর্জ্যের পরিমাণও কম ছিল। কিন্তু এর ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে এর বর্জ্যের পরিমাণও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অপর্যাপ্ত প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে প্লাস্টিকদূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিল। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০০৫ সালে তিন কেজি থেকে বেড়ে ২০২০ সালে ৯ কেজি হয়েছে। শুধু ঢাকায়ই বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২৪ কেজি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তথ্য বলছে, বছরে দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয় প্রায় সোয়া আট লাখ টন। তবে এর মাত্র ৩৬ শতাংশ রিসাইকলড হয়ে নতুন পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে। বাকি ৬৪ শতাংশই পরিবেশ দূষণ করে, যার একটি বড় অংশও রিসাইকল করা সম্ভব।
আমরা প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করি। উৎপন্ন সব প্লাস্টিকের প্রায় ৩৬ শতাংশ প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে খাদ্য ও পানীয় পাত্রে একক ব্যবহারের প্লাস্টিকপণ্যসহ প্রায় ৮৫ শতাংশ ল্যান্ডফিল বা অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য হিসেবে শেষ হয়। ইএনইপি থেকে জানা যায়, প্রায় ৯৮ শতাংশ একক ব্যবহারের প্লাস্টিকপণ্য জীবাশ্ম জ্বালানি বা ‘ভার্জিন’ ফিডস্টক থেকে উৎপন্ন হয়। প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক প্লাস্টিকের উৎপাদন, ব্যবহার ও নিষ্পত্তির সঙ্গে যুক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা ২০৪০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কার্বন বাজেটের ১৯ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে পাতলা প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। হাইকোর্টের একটি নির্দেশনায় উপকূলীয় অঞ্চলে এবং সারা দেশের হোটেল-মোটেলে একক ব্যবহারের প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছিল ২০২০ সালে। এ ছাড়া পাট প্যাকেজিং আইন-২০১০ সক্রিয়ভাবে ধান, সারসহ ছয়টি প্রয়োজনীয় জিনিসের বিকল্প প্যাকেজিংয়ের প্রচার করে। দুর্ভাগ্যবশত, প্রশংসনীয় সাহসী পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এটা সত্য, সরকার একা প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারবে না। পরিবেশে প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রবাহ বন্ধ করতে পদ্ধতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন।
এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী উৎপন্ন সাত বিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশেরও কম পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে। লাখ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের মধ্যে হারিয়ে যায় বা কখনো কখনো হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে পাঠানো হয়, যেখানে বেশির ভাগই পোড়ানো হয় বা জমা করে রাখা হয়। সিগারেটের বাঁট, যার ফিল্টারগুলোতে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক ফাইবার থাকে, এটি পরিবেশে পাওয়া সবচেয়ে সাধারণ ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য। এ ছাড়া আছে খাবারের মোড়ক, প্লাস্টিকের বোতল, প্লাস্টিকের বোতলের ক্যাপ, প্লাস্টিকের মুদির ব্যাগ ও প্লাস্টিকের স্ট্র। আমরা অনেকেই প্রতিদিন এই পণ্যগুলো ব্যবহার করি, এমনকি সেগুলোর শেষ কোথায় হতে পারে সে সম্পর্কে চিন্তা না করে।
প্লাস্টিক বর্জ্য নদী, সমুদ্র বা স্থলভাগে শতাব্দী ধরে পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। প্লাস্টিকের স্থায়িত্ব এবং অবক্ষয়ের প্রতিরোধ বৈশিষ্ট্য প্লাস্টিককে এত জনপ্রিয় করেছে। আবার এই বৈশিষ্ট্যের কারণে প্লাস্টিক প্রকৃতিতে সম্পূর্ণরূপে মিশে যেতে পারে না। বেশির ভাগ প্লাস্টিক ছোট ছোট টুকরা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ও শোষণের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে এবং অঙ্গগুলোতে জমা হতে পারে। আমাদের ফুসফুস, যকৃৎ, প্লিহা এবং কিডনিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, সম্প্রতি একটি গবেষণায় নবজাতক শিশুদের প্লাসেন্টাসে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এর কুপ্রভাবের সম্পূর্ণ মাত্রা এখনো অজানা। তবে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে প্লাস্টিক সম্পর্কিত রাসায়নিক পদার্থ, যেমন—মিথাইল পারদ, প্লাস্টিকাইজার ও শিখা প্রতিরোধক শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং স্বাস্থ্য উদ্বেগের সঙ্গে যুক্ত। সামগ্রিকভাবে প্লাস্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত তৈরি করছে।
যেকোনো দূষণ মোকাবেলায় ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার, জাতীয় সরকার ও জাতিসংঘের সমন্বিত ভূমিকা প্রয়োজন। প্লাস্টিকদূষণ মোকাবেলায় সচেতনতা তৈরির জন্য জাতিসংঘ ২০১৮ সালে পরিবেশ দিবসের উপপাদ্য করেছিল Beat Plastic Pollution। সেই কার্যক্রম এখনো চলমান। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে প্লাস্টিকদূষণ ও প্লাস্টিক বর্জ্য কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া প্লাস্টিকের বিকল্প উদ্ভাবনে গবেষণাকে উৎসাহিত করে, বিকল্প উদ্ভাবনকে বাজারে টিকিয়ে রাখার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে এবং সর্বশেষ বিকল্প না আসা পর্যন্ত প্লাস্টিকশিল্পকে টিকিয়ে রাখার পারকল্পনা সরকার করতে পারে। নতুন নতুন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি প্লাস্টিকশিল্পে নিয়ে এসে এবং রিসাইকলকে উৎসাহিত করে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন কমানোতে প্লাস্টিকশিল্পগুলো ভূমিকা রাখতে পারে।
শিক্ষা কার্যক্রমে প্লাস্টিকদূষণের ভয়াবহতা তুলে ধরে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরিতে নিরুসাহ করতে হবে। স্থানীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অপচনযোগ্য বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে করা হচ্ছে না বলে আমরা রাস্তাঘাটে যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য দেখতে পাই। স্থানীয় সরকারের এ বিষয়ে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে অপচনযোগ্য বর্জ্য (প্লাস্টিকসহ) আলাদাভাবে সংরক্ষণ করে বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা না করলে স্থানীয় সরকারের পক্ষে এ বিষয়ে সফল হওয়া কঠিন।
একজন ব্যক্তি হিসেবে আমিও অনেক কিছু করতে পারি, বাজারে গেলে প্লাস্টিকপণ্য যত দূর সম্ভব বর্জন করে পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ ব্যবহার করতে পারি, প্লাস্টিকপণ্য বর্জনে অন্যকে উৎসাহিত করতে পারি, নিজের এলাকা প্লাস্টিক বর্জ্যমুক্ত রাখার উদ্যোগ নিতে পারি। এ ছাড়া স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কিভাবে তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে পারে, সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারি।
মানুষের তৈরি প্লাস্টিক যেমন আমাদের জীবনে উন্নতি ও স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে, তেমনি এর অতিরিক্ত ও খারাপ ব্যবহার মানবজাতিকে পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সমন্বিত উদ্যোগই পারে এই দূষণের হাত থেকে আমাদের দেশ ও পৃথিবীকে মুক্ত রাখতে।