মোহাম্মদ বাবুল ,কুয়াকাটা প্রতিনিধি : পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ৮টি মৌজার জমা জমি ক্রয় বিক্রয়ের ওপরে বিগত ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে বিগত সরকার। বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের পার্মিশন ছাড়া এসকল মৌজার কোনো জমি বিক্রি করতে পারছেন না ভূমির বৈধ মালিকরা। বিভাগীয় কমিশনারের পার্মিশনে গিয়ে মাসের পর মাস বিভিন্ন অফিসের দুয়ারে ধরনা দিতে হয় । ইউনিয়ন ভূমি সরকারি (তহশীলদার) থেকে শুরু করে উপজেলা ভূমি অফিস(এসি ল্যান্ড অফিস), ইউএনও অফিস, ডিসি অফিস ও বিভাগীয় কমিশনারের অফিস এর কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের খুশি করে এ কাজটি করাতে হয় বলে ভূক্তভোগীরা জানান। পারমিশনে গেলে দলিল লেখক ও মোহরিদের দিতে হয় টাকা।
সরজমিনে অনুসন্ধানে করেলে জানা গেছে শুধু মাত্র মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে পারলেই মেলে কাংখিত পার্মিশন, তা ও আবার কয়েক মাস ঘুরে। ঘুষ না দিলে পার্মিশন পাওয়া যায় না। বিভিন্ন অফিসে ঘুরে, না না জনের দ্বারস্থ হয়ে, হতে হয় না না রকম হয়রানী ও হেনস্তার শিকার। এদিকে পার্মিশন জটিলতার কারনে কলাপাড়া উপজেলার ৮টি মৌজার শতকরা প্রায় ৮০/৯০ ভাগ দলিলই আটকে আছে সাব রেজিস্টারের টেবিলে। ফলে চিকিৎসা, শিক্ষা, ধার-দেনা পরিশোধ, সন্তানাদির বিবাহসহ নানা রকম জরুরী প্রয়োজনে নগদ টাকা সংগ্রহ করতে না পেরে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সেই সাথে দলিল রেজিষ্ট্রি কম হওয়ায় সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় থেকে। উল্লেখ্য ২০১২ সালে সাবেক প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের এক উন্নয়ন মূলক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কলাপাড়া উপজেলার সাবেক ৪টি, বর্তমান ৮টি মৌজার জমা-জমি বিভাগীয় কমিশনার এর পূর্বানুমতি ছাড়া বেচা বিক্রি করা যাবে না মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়।
মৌজা ৮ টি হল, কুয়াকাটা, আলীপুর, খাজুরা, লতাচাপলী, দক্ষিন লতাচাপলী, চরচাপলী, গঙ্গামতি ও কাউয়ার চর। এর আগে সরকার কুয়াকাটা টুরিজম সেন্টার (কেটিসি)মাষ্টার প্লান ২০১০-৩০অনুমোদন করেন। উক্ত মাষ্টার প্লান অনুমোদন করার পর এক যুগেরও বেশি সময় পার হলেও মাষ্টার প্লান অনুযায়ী পর্যটন কেন্দ্র উন্নয়ণে কোন কার্যক্রম শুরু করা হয়নি। পর্যটন কেন্দ্রের সৌন্দার্য বর্ধন ও উন্নয়নে সড়ক মহা সড়ক নির্মান, বিভিন্ন স্থপনা তৈরী, পরিবেশ সংরক্ষনের জন্য বনায়ন তৈরির কথা থাকলেও এর ছিটে ফোটা চিহ্ন পর্যন্ত নেই কোথাও। শুরু করা হয় নাই জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। অথচ ভূমি বেঁচা কেনায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বছরের পর বছর ধরে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রেখে ছিল বিগত সরকার। কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক অথচ জরুরী প্রয়োজনে এক খন্ড জমি বিক্রি করতে না পারায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন কেহ, চিকিৎসা খরচ চালাতে না পেরে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে কেহ কেহ বিছানায় পরে আছেন । অনেকে আবার পরের দেনা পরিশোধ করতে না পারায় জেল খাটতে হয়েছে । সন্তানদের বিবাহ শাদী করানো ও লেখা পড়া শিখানোর ক্ষেত্রেও হিম-সীম পোহাতে হচ্ছে তাদের। পরতে হচ্ছে নানা রকম বিড়ম্বনায়। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী যার যার সামর্থ অনুযায়ী জমি কেনা এবং বিক্রি করার অধিকার রয়েছে প্রতিটি নাগরিকের। কুয়াকাটা পৌরসভা এবং ধুলাসর ও লতাচাপলী ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। তারা স্পষ্টতই বৈশম্যের শিকার। উক্ত বৈশম্য দূর করার জন্য বিতর্কিত পার্মিশন প্রথা বাতিল করার জন্য বর্তমান সরকারের কাছে জোড় দাবী জানাচ্ছে কুয়াকাটা-লতাচাপলী ও ধুলাসরের মানুষ।
মো: হারুন মিয়া (৫০) নামে এক অটোরিকসা চালক বলেন, আমার বাপের ৩ একর ৪৫ শতাংশ জমি ছিল। বাবা মারা যাবার পর আমরা ভাই বোনেরা উক্ত জমির মালিক। আমরা ওয়ারিশরা মিলে উক্ত জমি ৪ কোটি ৫০ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে ১৫ লক্ষ টাকা নগদ গ্রহণ করে উক্ত জমির বায়না দলিল রেজিষ্ট্রি করে দেই। কিন্তু বিগত ৫ বছরেও পার্মিশন আনতে না পারায় কবলা দলিল দিতে পারছি না। পার্মিশনের পিছনে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছি। যার সাথে বায়না করেছি সেই মালিক আমাদের জমি চাষ করতে দেয় না। দেনার দায়ে নিরুপায় হইয়া অটো চালাতে বাধ্য হয়েছি। এদিকে জমির দাম বেড়ে দ্বিগুনেরও বেশি হয়েছে। নানা টেনশনে দুই বার ষ্টোক করেছি।
হারুন মিয়ার মত পৌর শহরের শাহ আলম খলিফা(৪৫), খাজুরার নুর সাঈদ বিশ্বাস(৬০), দক্ষিন লতাচাপলীর হাবিবুর রহমান(৬৫), আলীপুরের নাসির খলিফা(৪০) ছাড়াও এরকম আরও শত শত মানুষ আছে যাদের জীবনের গল্প প্রায় একই রকম। পার্মিশনের গ্যাড়াকলে বন্ধি হয়ে আছে তাদের জীবন। পৌর শহরের ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ জানান, পার্মিশন আনতে হলে জমির সকল কাগজ পত্রসহ বরিশাল বিভাগীয় বমিশনারের কাছে আবেদন করতে হয়। বিভাগীয় কমিশনার উক্ত আবেদন পাঠিয়ে দেন পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের কাছে। জেলা প্রশাসক পটুয়াখালী আবেদন পত্রটি পাঠান আবার কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার পাঠিয়ে দেন কলাপাড়া এসিল্যান্ড অফিসে। এসিল্যান্ড পাঠান মহিপুর তহসিল অফিসে। তহসিলদার সকল কাগজপত্র দেখে সরজমিনে তদন্ত করে জমির মালিকানা ও দখল সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে রিপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও ভূমি মালিককে নানা প্রকার ভয় ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে বাধ্য করেন। অথচ সর্বশেষ রেকর্ড বহিতে ভূমি মালিকের নাম থাকলে এবং জমির হাল সন পর্যন্ত খাজনা পরিশোধের রশিদ থাকলে বাংলাদেশের যে কোন ভূমির মালিক যে কোন সময় তাঁর জমি বিক্রি করতে পারেন কিন্তু কুয়াকাটার ভূমি মালিকদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম। মো: সেলিম হাওলাদার হাওলাদার(৫৫) বলেন, মহিপুর তহসিল অফিসে জমির পার্মিশনের জন্য গেলে প্রথমেই তারা বিগত বিএস জরিপের ভুলে ভরা প্লট ইনডেক্স বের করে বলে আপনার জমির প্লটে ভুল আছে। আপনি পার্মিশন পাবেন না। কেস প্রতি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিলে তিনিই আবার রিপোর্ট দিয়ে দেন। তিনি আরও বলেন, উপজেলা ভূমি অফিসে কেস প্রতি ১০ হাজার, ইউএনও অফিসে ৬ হাজার, ডিসি অফিসে ৫ হাজার এবং বিভাগীয় কমিশনার অফিসে ৫ হাজার ক্ষেত্র বিশেষ আরও বেশি টাকা ঘুষ দিতে হয়।
আপনার মতামত লিখুন :