সোহেল রানা। একাধারে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা। ’৭১ সালকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন তিনি। সেসময় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। আজ ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের ‘হ্যালো…’ বিভাগে কথা বলেছেন তিনি
* সত্তরোর্ধ্ব বয়সে এসে আজকের বিজয় দিবসের আনন্দ আপনার কাছে কেমন লাগেছ?
** রাতদিন তফাৎ বলা চলে। তখন নিজে দৌড়ে সব গরম করে রাখতাম। স্লোগানে স্লোগানে আনন্দ উপভোগ করতাম। এখন বয়স হয়েছে। ১৯৭১ সালে আমার যে বয়স ছিল বর্তমান সময়ে সে বয়সি তরুণ-তরুণীদের বিজয় দিবস উদ্যাপনটা উপভোগ করি। অবশ্য এখন তো বিশেষ দিবসগুলো আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
* ১৯৭১ সালে আপনার যুদ্ধে যাওয়ার কারণ এবং চাওয়া কী ছিল?
** পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের মুসলিম ভাবলেও নানা বৈষম্য তৈরি করেছিল। বলা চলে আমাদের তৃতীয় শ্রেণির মানুষ ভাবত। নানাভাবে নির্যাতন করত, যেগুলো অসহনীয় ছিল। মনে প্রাণে চাইতাম কবে আমরা স্বাধীন হবো। ’৭১-এর যুদ্ধে আমার ইচ্ছাটাই ছিল কবে নাগাদ আমরা স্বাধীন হবো? শেষতক আমরা মুক্তির পতাকা আনতে পেরেছি।
* ২৫ মার্চের কালরাতে কোথায় ছিলেন?
** ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে তো আমি মারাই পড়তাম! তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে থাকতাম। সেদিন দিনের বেলা হল থেকে বাসায় গিয়েছি। কী মনে করে আমার ভাবি বললেন, ‘ভালো রান্না হয়েছে। আজ আর হলে যেওনা পারভেজ।’ ভাবির কথা শুনে আমি আর হলে গেলাম না। অন্যদিকে ওই রাতেই পাকিস্তানি হানাদারের আক্রমণে হলের মধ্যে আমার অনেক সহপাঠী মারা গেল।
* মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতি এখনো আপনার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে?
** মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক ঘটনাই এখনো চোখে ভাসে। শুধু একদিনের ঘটনার কথা বলি। সারারাত হেঁটে খুব ক্লান্ত হয়ে কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজারের কাছে গেলাম। তখন প্রচণ্ড ক্ষুধা। আমার বন্ধু মোস্তফা মহসিন মন্টু বলল, ‘দেখ কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা’। আমরা চাদরের আড়ালে স্টেনগান নিয়ে বাইরে বের হতাম। একদিন আমরা হাঁটছিলাম খাবারের সন্ধানে। একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলাম কতগুলো মুরগি ছোটাছুটি করছে। মনে হলো, এ বাড়িতে গেলে হয়তো ডিম পাওয়া যাবে। বাড়িতে ঢুকতেই এক বয়স্ক মহিলার সঙ্গে দেখা। তাকে বললাম, ‘মা, আমাদের কাছে কিছু ডিম বিক্রি করবেন’? তিনি বলল, ‘বাবা ডিম তো নেই।’ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা মন খারাপ, রওয়ানা দিয়েছি, ঠিক তখন ঘুরে পেছনে তাকিয়ে দেখি, এক লোক ওই মহিলার কাছ থেকে দুটো ডিম নিয়ে যাচ্ছে। দেখেই আমার খুব রাগ হলো। গায়ের চাদর সরিয়ে বন্দুক বের করলাম। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, ডিম থাকা সত্ত্বেও আমাকে দিলেন না কেন? মহিলা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘ডিম কোথায়?’ আমি বললাম, ‘এইমাত্র আপনি ওই লোকটিকে ডিম দিলেন!’ তখন মহিলা বললেন, ‘ওইটা তো ডিম নয়। আমি ওকে বদা দিয়েছি।’ ডিমকে ওরা আঞ্চলিক ভাষায় ‘বদা’ বলত। বুঝলাম, ডিম বলাতে মহিলা সেটি কী জিনিস চিনতে পারেননি। পরে ওই মহিলা আমাদের ত্রিশটা ডিম দিয়েছিলেন। কোনো দাম নেননি। ডিমগুলো এনে আমরা সিদ্ধ করেছি। একটা করে ডিমও আমাদের ভাগে পড়েনি। অর্ধেক করে খেয়েছি।
* আপনি কী মনে করেন এ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সিনেমার মাধ্যমে জানান শেষ?
** প্রশ্নই আসে না। আমার সিনেমা ‘ওরা ১১ জন’কেও তো পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই সরকারের সহযোগিতা দরকার। তবে সরকারি সহযোগিতার নামে অনুদান দেওয়ার বিষয়টি আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। এর দুটি কারণ আছে। একটি হচ্ছে, যে পরিমাণ টাকা অনুদান দেওয়া হচ্ছে, সেটা দিয়ে একটি সিনেমা সত্যিই কি বানানো সম্ভব? দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, কাদের অনুদান দেওয়া হচ্ছে, তাদের বয়স কত, এটিও জানা দরকার।
* ‘ওরা ১১ জন’র পর আর কোনো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা বানালেন না কেন?
** ‘ওরা ১১ জন’ আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম। সিনেমাটি মুক্তির পর মানুষের যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে তেমন একটা সাধুবাদ পাইনি। স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা নির্মাণের জন্য মাসুদ পারভেজ সরকারের কাছ থেকে পুরস্কৃত হননি, কিংবা একটি ধন্যবাদপত্রও পাননি। এতে করে এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে সামনে আগানোর ইচ্ছা নষ্ট হয়ে গেল। তাই আর সেটি নিয়ে কাজ করা হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন :