আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে ‘আশা জাগানিয়া’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তার বদলে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ-এপিপিজি।
সম্প্রতি বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা এপিপিজির এক প্রতিবেদনে দুই হাজারেরও বেশি নৃশংসতার বর্ণনা দিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামিকে সতর্ক করা হয়েছে।
এপিপিজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের আমলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও ‘তোষামোদি, দুর্নীতি ও মানবাধিকারে হতাশাজনক পরিস্থিতি’ ছিল।
এপিপিজির মতে, ‘আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে- সরকারি প্রতিষ্ঠান, গণতন্ত্র এবং মুক্ত মিডিয়ার প্রশ্নে আস্থার অভাব রয়েছে। তবে আমরা এমন প্রমাণ পেয়েছি, যা নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আইনকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতির অবসান ঘটানো এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব করতে ব্যর্থ হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ভালো প্রভাব পড়বে না’।
বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার রাজনীতিকরণ ‘নতুন কিছু নয়’ মন্তব্য করে প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ আমলে শ্রম আইন লঙ্ঘনের প্রশ্নে অভিযুক্ত হওয়ার পর অধ্যাপক ইউনূস ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন।
তবে আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে মাত্রাগত মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আনা হবে বলে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু হত্যার অভিযোগের সংখ্যা বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কিত কিছু গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ জানিয়েছে, ২৬৮টি মামলায় আওয়ামী লীগের ১ লাখ ৯৪ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ২৬ হাজার ২৬৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
তারা আমাদের বলেছেন, মামলা দায়ের অব্যাহত রয়েছে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন করার জন্য একটি অভিযোগে শত শত অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা বাংলাদেশে প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কয়েক দশক ধরে সাংবাদিকতা পেশাকে বাংলাদেশে যে ‘ব্যাপকভাবে রাজনীতিকরণ’ করা হয়েছে সেই বাস্তবতার কথা তুলে ধরে এপিপিজি বলেছে, আমাদের বলা হয়েছে, ২২ অক্টোবর পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সমর্থক হিসেবে বিবেচিত কমপক্ষে ৫৪ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং কমপক্ষে ৬ জন সাংবাদিক বাংলাদেশে আটক রয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দমনপীড়নের ব্যাপক নিন্দা জানিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তদন্তে পাওয়া সমস্ত লিখিত প্রমাণের মধ্যে এখন পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং আইনের শাসন নিয়ে আমরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। প্রাথমিক ছাত্র বিক্ষোভ, তাদের কর্মসূচি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেওয়া এবং তারপর শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর যখন হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, সবই বাংলাদেশি ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া ভালোভাবে কাভার করেছে। …আমাদের তদন্তে প্রচুর ব্যক্তিগত প্রমাণ পাওয়া গেছে যাতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার চিত্র রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরসহ বিভিন্ন মাজার ভাঙচুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যার মত সহিংসতার কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মব’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ৩৮ দিনে অন্তত ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের বরাতে এপিপিজি লিখেছে, সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক হামলায় পাঁচজন নিহত এবং ৬১৯ জন আহত হয়েছেন। গণপিটুনির ৫৩টি ঘটনা ঘটেছে, হামলা হয়েছে ১২টি মাজারে এবং ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিচার বহির্ভূত ৬ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ জানিয়েছে, ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ৫,৮১৮টি অস্ত্র লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩,৯৩৩টি উদ্ধার করা হয়েছে এবং ১,৮৮৫টি অস্ত্র খোয়া যাওয়া অবস্থায় রয়েছে-যার মধ্যে আছে রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি ও পিস্তল। এর বাইরে তিন লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এপিপিজি বলছে, বাংলাদেশ হিন্দু অ্যাসোসিয়েশনের (ইউকে) কাছ থেকে তারা মৌখিক সাক্ষ্য এবং বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের কাছ থেকে লিখিত সাক্ষ্য নিয়েছে। বাংলাদেশের খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতার বিস্তারিতও শুনেছে এপিপিজি। তাছাড়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতার কথা তারা শুনেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪ অগাস্ট থেকে ২০ অগাস্টের মধ্যে ২০১০টি সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যে খুনের ৯টি, ধর্ষণের চারটি, উপাসনালয় ভাঙচুরের ৬৯টি এবং বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ৯১৫টি ঘটনা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে খুলনা বিভাগে, যেখানে চারজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন বাক প্রতিবন্ধী রয়েছেন।
বাংলাদেশে ‘ইসলামপন্থি চরমপন্থা ক্রমাগত বাড়ছে’ মন্তব্য করে এপিপিজি যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেই সংকট আরও খারাপ হলে সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও সতর্ক করেছেন ল্যামি।তিনি গণতান্ত্রিক শাসনকে সমর্থন এবং এ অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়েছেন।
এপিপিজি বলেছে, বাংলাদেশ কমনওয়েলথ সদস্য হওয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। তাছাড়া যুক্তরাজ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি থাকায় এদেশের পরিস্থিতি অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
লিখিত ও মৌখিক সাক্ষ্য এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের মাধ্যমে সংকলিত এই প্রতিবেদনের লক্ষ্য হলো- বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকদের অবহিত করা এবং জরুরি বিষয়গুলো সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের ‘সচেতন’ করা।
প্রাপ্ত ফল সরকার, দাতব্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ ও কমনওয়েলথের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য অংশীদারদের জানানো হবে। আশা করা যায়, এই বিষয়গুলো পার্লামেন্টে উত্থাপন করা হবে এবং এই প্রতিবেদনটি সংসদ সদস্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অবহিত করতে সহায়তা করবে।
আপনার মতামত লিখুন :