অতীতের রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবে


আজকালের কণ্ঠ প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২৭, ২০২৪, ১০:৪৩ অপরাহ্ন /
অতীতের রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবে

সাহিদুল এনাম পল্লব : ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক জঘন্য অত্যাচারের পক্ষের সমর্থনকারীরাই প্রশ্ন তুলে স্বাধীনতা সংগ্রামের ৩০ লক্ষ শহীদ এবং ২ লক্ষ ৩০ হাজার নারীর সংযোম লুন্ঠনের সংখ্যা নিয়ে।

আমরা বাংলাদেশের স্বাধীন অর্জন করেছি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যম দিয়ে। ৫৩ বছর অতিবাহিত হতে চলল। ৯ মাস ব্যাপী যুদ্ধ চলেছে বাংলাদেশের মাটিতে। এই ৯ মাসের যুদ্ধে জীবন দিয়েছে ৩০ লক্ষ বাংলার সাধারণ ছাত্র জনতা কৃষক দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষ। ২ লক্ষ ৩০ হাজার মা বোন হারিয়েছে তাদের মূল্যবান সম্পদ সংযম। তাদের আত্মত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে আজ আমাদের বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা আমরা একটি নতুন দেশ পেয়েছি লাল সবুজের বাংলাদেশ। আমরা পেয়েছি একটি পতাকা একটি ভূখণ্ড কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষ আজ ও স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করতে পারিনি। পতাকা মানচিত্রের বদল হলেও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি হয়নি। বন্ধ হয়নি শ্রম শোষণ, লুন্ঠন ,দুর্নীতি ,বিদেশে অর্থপাচার। তৈরি হয়নি বেকারদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের স্থান। দেশের মানুষের সুচিকিৎসার কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা আজও রাষ্ট্র করতে পারেনি। তবে শোষণ লুন্ঠন দুর্নীতির কারণে তৎকালীন পাকিস্তানের ২২ পরিবার থাকলেও আজ বাংলাদেশে কয়েক হাজার পরিবার করে উঠেছে যাদের কাছে বাংলাদেশের প্রায় সমগ্র অর্থ জিম্মি হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার সংগ্রামের পরেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ছাত্র জনতা বারবার স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলন করে জীবন দিয়েছে।

কিন্তু মানুষের কাঙ্খিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষার বৈষম্যসহ শিক্ষাকে পণ্যের রূপান্তরিত করেছে এবং শিক্ষা হয়েছে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যের আড্ডাখানা। বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের নামে সরকারি আমলা দের সাথে যোগ সাজোরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিতে নিয়োগ পাইয়ে দেয়া নিত্যনৈমন্তীর ঘটনা। সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে যে কোন চাকরির ক্ষেত্রেই ঘুষ লেনদেন একটা বৈধ সমাজ ব্যবস্থার বিচারে পরিণত করেছে। এদেশের অসৎ ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক পুঁজির দ্বারা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেগুলোতে নামমাত্র শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট ক্রয় করে। এমন কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ আছে যদি কোন শিক্ষার্থী সেমিস্টারের টাকা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদেরকে ফেল করিয়ে দেয়া হয় । টাকা দিতে পারলে তাদের পাশ করিয়ে দেয়। জাতি হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ মেধাশূন্য এবং দুর্নীতিপরায়ণ। দুর্নীতি এখন শিল্পে পরিণত হয়েছে।

পাশাপাশি দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এতই লাজুক অবস্থা যে প্রতিটা মানুষ তার ঘরকে ওষুধ ফার্মেসিতে পরিণত করতে বাধ্য হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাজেটের ব্যাপক অংকের টাকা বরাদ্দ থাকলেও সেই বরাদ্দের প্রকল্পিত অর্থ সাধারণ মানুষের কাজে আসছে না। চিকিৎসা ক্ষেত্রে জনসাধারণকে ব্যাপক হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। হাসপাতাল গুলোতে ডাক্তার থাকলেও তারা নানা অজুহাত তুলে সাধারণ মানুষের সেবা থেকে বঞ্চিত করছে। প্রতিটা হসপিটালে নেই রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার যন্ত্রপাতি। সরকারি হাসপাতালে গেলেও তাদের নিয়মতান্ত্রিক ভাব দেখিয়ে রোগীদের চিকিৎসার অবহেলা করে তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো সহযোগিতায় দেশের ডাক্তাররা এবং প্রাইভেট হাসপাতালের মালিকরা মিলে এদেশের মানুষের এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছে যে কোন একজন ব্যক্তি ঘটনা ক্রমে কোনোভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জীবনের সমস্ত সম্পদ হাসপাতাল এবং ডাক্তারের পিছনে খরচ করে সর্বশ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক কৃষকেরা তাদের যতটুকু ক্ষুদ্র সম্পদ জমি ছিল তা হারিয়ে সর্বহারা কৃষকের পরিণত হচ্ছে। ডাক্তার এবং ক্লিনিকের মালিকেরা গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়। বাংলাদেশের সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না বিধায় অনেকের চিকিৎসা নিতে পাড়ি জমাচ্ছে পাশের দেশ ভারতে। প্রক্রিয়ায় ভারত আয় করছে হাজার হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে। অন্যদিকে আরো ধনীরা তাদের চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক সিগাপুর গমন করছে। অথচ এদেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের জন্য যে হসপিটালগুলো গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে তাদের জীবনের নেই কোন নিরাপত্তা ।চিকিৎসার নেই কোন সুব্যবস্থা। এই ধরনের আরো অনেক কাঙ্খিত বিষয় আছে যাহা মানুষের প্রাপ্য তারা মানুষ পাচ্ছে না।

২০২৪ এর জুলাই আগস্ট এর ছাত্র জনতার কোনো অভ্যুত্থান হাজারো কাঙ্খিত মানুষের একটি সম্মিলিত প্রতিরোধ। যে প্রতিরোধে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ বুক পেতে জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করেনি। হয়েছে ফ্যাসিবাদ স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন। ছাত্র-জনতার প্রায় ১৫-১৬ শত জীবনের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামো সহ যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল চরম বিপন্ন। একটি ইউনিয়নের মানুষ পাশের ইউনিয়নে কোন ঘটনা ঘটলে সেই খবর পেতো কয়েকদিন পরে। ছিল না কোন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছিল না তেমন প্রিন্ট মিডিয়া। ঘটনার কয়েকদিন পরে কিছু কিছু খবর যারা প্রিন্ট মিডিয়া পড়তো তাদের কাছে এসে পৌছাতো। জুলাই আগস্ট এর আন্দোলন ৩৬ দিনের কিন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার সংগ্রাম ৯ মাসের। যে ছেলেটি পিতা-মাতার অজান্তে পত্র লিখে বাড়ি থেকে পালিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী যোগদান করেছে আর কোনদিন ফিরে আসেনি সে তো নিখোঁজ। অনেক বনে বাদাড়ে পাক হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়েছিল যেগুলো শিয়াল কুকুরে খেয়ে ফেলেছে অজ্ঞাত মেলেনি তাদের সন্ধান। অনেকে যুবককে হত্যা করেছে ওই অঞ্চলের লোক সেই যুবকের লাশ দেখে বলতে পারিনি এই লাশ কার অবশেষে অজ্ঞাতলা হিসাবে গ্রামের মানুষ দাফন করেছে। তার প্রিয়জন জানে না তার প্রিয়জন কোথায় গেছে? সেদিন তো আর আজকের মত লক্ষ লক্ষ মোবাইল ক্যামেরা ফেসবুক ইন্টারনেট ছিলনা যে কোথাও কোন ঘটনা ঘটলেই দেশের মানুষ দ্রুততা জানতে পারবে। রাস্তায় বনে অনেক বৌদ্ধভূমিতে নারীর ক্ষতবিক্ষত ধর্ষিত দেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে কেউ তাকে চেনে না সে অজ্ঞাত। এক রাত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৫ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি পায়খানার বাহিনী। যুদ্ধ পরবর্তী পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার এবং ধ্বংসাবশেষ দেখে বিশ্বের অনেক দেশ হতভম্ব হয়ে তারা জিজ্ঞাসা করেছে যে কিভাবে একটি দেশ স্বাধীনতাকাবিদের উপর এই ধরনের জঘন্যতম অত্যাচার করতে পারে।

পাকিস্তানি দের সেই ভয়াবহ অত্যাচার ধ্বংসলীলা ধর্ষণ ,হত্যা, পিতার সামনে কন্যাকে ধর্ষণ , ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণ, পিতা এবং ছেলের সামনে কন্যা এবং মাকে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পরে তাদেরকে গুলি করে হত্যা, পিতা পুত্রকে একসাথে গুলি করে হত্যা। এই সমস্ত জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পক্ষে যারা সাফাই গেয়ে বলতে চায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামী ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হইনি দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার মা-বোন ধর্ষিত হইনি। এ কথাগুলোর মাধ্যম দিয়ে তারা এটাই প্রমাণিত করতে চয়। পাকিস্তান বাংলাদেশের মানুষের উপর স্বাধীনতার সংগ্রামে কোন অত্যাচার করেনি। যারা মারা গেছে তাদের তালিকা দেন। তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা গ্রামীণ অবকাঠামো অবস্থা এবং মানুষের আত্মসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সেই তালিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে করা সম্ভব ছিল না।

সেটাতো ৫৩ বছর আগে আজ যখন ২০২৪ এর ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পেটুয়া বাহিনীর হাতে যারা নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে আজ বিগত কয়েক মাস হয়ে গেল জাতির সামনে কি সেই তালিকা উত্থাপিত হয়েছ ? ২০১৩ সালের ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আন্দোলন করতে যেয়ে তৎকালীন পুলিশের গুলিতে কতজন মারা গিয়েছিল তার তালিকা কি আপনারা দিতে পারবেন? অনেকে বলেছেন ৩ হাজার ৪ হাজার ৫ হাজার। কিন্তু সেই তালিকা দেন আপনারা দিতে পারবেন না। ১৯৭১ সালের গণহত্যার দায় যাদের কাঁধে পড়ে আজকে তারাই বাংলাদেশের প্রশ্ন তোলে ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হয়নি ২ লক্ষ ৩০ হাজার মা বোন ধর্ষিত হয়নি।

জুলাই আগস্টের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে অনেকে দাবি করছে সমন্বয়কদের অধিকাংশ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির কর্মী ছিল। আমার প্রশ্ন যদি বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের রাজনীতি ধারণ করতে তাহলে ছদ্মবেশে সাধারন ছাত্র সেজে সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলন করতে হত না। এই আন্দোলন কোন একক দলের নয় আবার শুধু ছাত্রদের আন্দোলন নয় । এই আন্দোলন বাংলাদেশের অপমার সকল জনসাধারণের। এই আন্দোলনের সফলতা ঘিরে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার পায়তারা এদেশের মানুষ মেনে নেবে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন বাংলাদেশের মানুষ সেটা রুখে দেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আওয়ামী লীগের একক সাফল্য নয় সেই সময়ে জামাতে ইসলাম এবং মুসলিম লীগ ভিন্ন সমগ্র রাজনৈতিক দল এবং অপমার জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম। এদেশে বন্ধ করতে হবে নিঃস্ব একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে আওয়ামী লীগের ভাওতাবাদী ব্যবসা এবং মানুষের ধর্মের দুর্বলতার দোহাই দিয়ে ভন্ড ধর্ম বাজদের ব্যবসা। সেই সাথে বন্ধ করতে হবে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নামে সংখ্যালঘুদের ধর্ম ব্যবসা।

এই দেশ কোন একক ধর্মের মানুষের দেশ নয়। এই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে মুসলিম, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আদিবাসী,জাতি উপজাতি সাঁওতাল হাজং, মুরং ,কুকি ,চাকমা, খাসিয়া,সহ সকল উপজাতি। ২৪ শে গণঅভ্যুত্থান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যুত্থানকে ধর্মবর্ণ জাতি উপ-জাতিতে বিভক্ত না করে শান্তিময় বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারলে গণঅভ্যুত্থানে জীবন দানকারী শহীদদের স্বপ্ন সফল হবে।

এর জন্য প্রয়োজন জুলাই আগস্টের গণহত্যা কান্ডের জড়িতদের দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে। সেই সাথে নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সন্ত্রাসমুক্ত ,সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত, কালো টাকার প্রভাবমুক্ত ,একটি সুস্থ সংসদ নির্বাচন । যার মাধ্যমে যারা এই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা অতীতের রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।